রূপময় বাংলাদেশ Headline Animator

07 November, 2012

বাঙালির ঐতিহ্য - গ্রামীণ মেলা



বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন হল গ্রামীণ মেলা। নদীর ধারে, দুই তিন গ্রামের সীমান্তবর্তী কোনও জায়গায়, বড়ো কোনও খোলা মাঠ কিংবা  বিশালাকারের কোনও বট, পাকুড় বা অশ্বত্থ গাছকে কেন্দ্র করে অবস্থিত কোনও খোলা মাঠে  সাধারনত মেলার আয়োজন করা হয়। সেই প্রাচীন কাল থেকে গ্রামীণ জীবনে প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে আসছে এই সব গ্রামীণ মেলা। আগে দূর দুরান্ত থেকে লোক সমাগম হতো এই সব মেলায়। উতসবপ্রিয় বাঙালি নানা রকম ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানের আনুষঙ্গ হিসেবে এই মেলার আয়োজন করে আসছে বরাবরই।


বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস বৈশাখ থেকেই এই উৎসব শুরু হয়ে যায়। শীতের শেষে ফসল কাটার ধুম পড়ে যায়। বৈশাখী ফসল ঘরে তোলার আমেজকে আরেকটু ঝালিয়ে নিতেই এই বৈশাখী মেলার আয়োজন। দূর দুরান্ত থেকে লোকজন আসে এই সব মেলায় তাদের পণ্যের পসরা নিয়ে। কি নেই এখানে? পুঁতির মালা থেকে শুরু করে বাঁশের বাঁশি, কাঠ বা বাঁশ দিয়ে তৈরি নানা রকম খেলনা ও গৃহসামগ্রী, মৃৎ শিল্প ও কারু শিল্প জাত পণ্য সামগ্রী, নানারকম কাঁচের চুড়ি, ছাঁচের তৈরি বাহারি সন্দেশ, নানা রকম খৈ, কদমা, নানা প্রকার মিষ্টি পর্যন্ত সাজান থাকে এই সব মেলায়। কোনও কোনও মেলায় একপাশে থাকে পুতুল নাচ কিংবা পালাগান অথবা বাউল গানের ব্যাবস্থাও। বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদে এই মেলা বসে।


বর্ষাকালে সাধারণত কোনও গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয় না। কিন্তু বর্ষা শেষ হতে না হতেই আবার নতুন উদ্যমে মেলার আয়োজন শুরু হয়ে যায়। গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে বিভিন্ন এলাকায় এই সব মেলা বসে। শরত এলেই পুজার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে যায় হিন্দু জনগোষ্ঠী। আর সেই সাথে তাল মিলিয়ে মেলার ও আয়োজন শুরু হয়। দুর্গা পুজার সময়ে একটু বেশি জাঁকজমকের সাথেই মেলার আয়োজন জমে উঠে।

হেমন্তে নবান্ন উতসবের পাশাপাশি ও মেলা বসে অনেক জায়গায়। শীতের আগে এবং  শীতের সময়ে জাঁকিয়ে বসা এই সব গ্রামীণ মেলায় সাধারনত প্রধান আকর্ষণ থাকে যাত্রাপালা কিংবা সার্কাস। কাঠের তৈরি ছোট ছোট নাগরদোলা ও থাকে অনেক মেলায়।
শীতের শেষে বসন্তে ও মেলা বসে অনেক এলাকায়। এই সব মেলায় প্রধান আকর্ষণ হিসেবে থাকে গরুর দৌড় প্রতিযোগিতা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি খেলা।


আর তা ছাড়া প্রতি বছর শীতের শেষে বগুড়ার পোড়াদহে খুবই আলাদা রকমের মেলার আয়োজন হয়। এই মেলা মাছের মেলা। হ্যাঁ। আপনি ঠিক ই পড়েছেন। মাছের মেলা। দেশের সব এলাকা থেকেই লোক আসে এইখানে। এই মেলার প্রধান আকর্ষণ বিশাল আকারের সব মাছ। তবে এর পাশাপাশি মাঝারি ও ছোট আকারের মাছ ও পাওয়া যায়। আর তার সাথে থাকে গ্রামীণ মেলার সব রকমের আয়োজন। গৃহস্থালি জিনিস থেকে শুরু করে পালাগান, সার্কাস ও নাগরদোলাও।

সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে এখন মানুষের মাঝেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে এখন আর আগের মতো করে সব এলাকায় মেলা জমে উঠে না। কিন্তু আরেকদিকে নতুন নতুন করেও কিছু মেলার আয়োজন ঠিক ই করে নিয়েছে বাঙালির উতসবপ্রিয় সত্ত্বা। কুষ্টিয়ায় বাউল সম্রাট লালনের জন্ম এবং মৃত্যু বার্ষিকীকে উপলক্ষ করে মেলার আয়োজন হয়। নড়াইলে চিত্রশিল্পী সুলতানের বাড়ির পাশেই বসে সুলতান মেলা। যশোরে কবি মধুসুদনের মৃত্যু বার্ষিকীতে আয়োজিত হয় মধু মেলা।


মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। মেলার ধরন ও বদলে যাচ্ছে। এখন মেলা মানেই শুধু নির্দিষ্ট কিছু পণ্য সামগ্রীর বিকিকিনি নয়। এখন মেলা কথাটির পরিসর অনেক বড়ো। বর্ষা কাল বৃক্ষ রোপণের মৌসুম। পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রেহাই পেতে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই বর্ষাকালে এখন পুরো দেশ জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত হয় বৃক্ষ মেলা। নানা রকম ফলদার বৃক্ষ ও কাঠ দানকারী বৃক্ষ ছাড়াও এই মেলায় থাকে দেশি বিদেশি নানা জাতের দৃষ্টি নন্দন গাছের চারা।

বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি আর সংস্কৃতি মানেই গ্রামীণ বাংলার শাশ্বত রূপ আর তার আচার অনুষ্ঠানের সমাহার। যুগ যুগ ধরে এই আচার অনুষ্ঠান চলে আসছে আবহমান বাংলায়। বাঙালির সত্ত্বার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে এই সব লোক অনুষ্ঠান। ধর্ম বর্ণের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিবর্ণ লোক উতসবে পরিণত হয়েছে এই সব গ্রামীণ উৎসব আয়োজন।

বি।দ্র। ছবিগুলি গুগল থেকে নেয়া হয়েছে।