রূপময় বাংলাদেশ Headline Animator

26 April, 2013

উঁচু মহল ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ী বনাম পোশাক শ্রমিক





২৪ শে এপ্রিল বুধবার, ২০১৩, সকাল ৮:৪০ এ বিকট শব্দ তুলে ভেঙে পড়ল সাভারের “রানা প্লাজা”। বাণিজ্যিক এই ভবনটিতে ছিল ব্যাংক- বীমা সহ আরও ৫ টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান। আগের দিন মঙ্গলবার বিকেলেই ভবনটির দেয়ালে বড়ো ধরনের ফাটল দেখা দেয়ায় সব গুলো প্রতিষ্ঠান ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। উপর মহল থেকে আদেশ দেয়া হয় ওই ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত যেন সব কাজ স্থগিত রাখা হয়। এই নিয়ে এক টিভি চ্যানেল প্রতিবেদন তৈরি করতে সাভারে যায়। ভবনের ফাটল নিয়ে প্রশ্ন করলে ওই ভবনের মালিক সোহেল টিভির রিপোর্টারকে বলেন, “ভবনের বড়ো ধরনের কোনও ক্ষতি হয়নি। সামান্য একটু প্লাস্টার খসে পড়েছে। এটা তেমন কিছু না”। এই কথায় গার্মেন্টস মালিকেরাও সুযোগ পেয়ে গেলেন। গার্মেন্টস কর্মীরা একটু শঙ্কা প্রকাশ করছিলেন ভেতরে যাওয়া নিয়ে। কিন্তু তাদেরকে ধমকে ভবনের ভেতরে কাজে নিয়োজিত করা হল। কাজ শুরু করার মাত্র ৪০ মিনিটের মাথায় ওই ভবন ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়লো। ভবন ধ্বসের সময় ভবন মালিক সোহেল রানাও ওই ভবনের নিচের তলায় ছিলেন। জনতার রোষানলে পড়ার ভয়ে তিনি বের হতে না পেরে স্থানীয় সাংসদসহ আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের খবর দেন। পড়ে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সাংসদ তৌহিদ জং মুরাদ ঘটনাস্থলে গিয়ে ভবন মালিক রানাকে বের করে নিয়ে যান। 

ভবন ভেঙে পড়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, “আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ইমারত নির্মাণের নিয়ম কানুন যথাযথ অনুসরণ করা হয়নি বলেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।“ এ ছাড়াও মন্ত্রী বলেন, “কিছু হরতাম সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে। ভবনটি ধ্বসে পড়ার পেছনে সেটিও একটি সম্ভাব্য কারন হতে পারে”। 

ভবন ধ্বসে পড়ার অব্যবহিত পরেই স্থানীয় লোকজন নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার কাজে নেমে পড়েন। তারপর একে একে তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন ফায়ার ব্রিগেড, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, সেনাবাহিনী এবং প্রচুর সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী। সেই সাথে সবার কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানানো হয়। বাংলাদেশের মানুষ আরও একবার কাজেকর্মে প্রমান করে দেখাল যে তারা আসলেই কতোটা আবেগপ্রবন জাতি। দিন নেই রাত নেই, ধনি গরিবের বিভেদ নেই – সাধারণ মানুষেরা সবাই একজোট হয়ে যে যেভাবে পারে উদ্ধারকাজে সাহায্য করেছে। টাকা দিয়ে, শ্রম দিয়ে, সেবা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সবাই উচুস্তরের স্বার্থান্বেষী মহলকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে তারা করতে চাইলে আসলেই অনেক কিছু করতে পারে। 

বাংলাদেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বিপদ মোকাবিলা করার মতো সরঞ্জাম নেই বললেই চলে। একের পর এক বিপদ ঘটে যাবার পরেও দেশের উপর মহল থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জন্য কোনও পদক্ষেপ গ্রহন করা হয় নি। শুধুমাত্র উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অভাবে উদ্ধার অভিযান বিলম্বিত হচ্ছে। একটু একটু করে দেয়াল ভেঙে বা পিলার কেটে আটকে পড়া লোকজনদের জীবিত বা মৃত বের করে আনা হচ্ছে। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড়ো এবং মর্মান্তিক ভবন ধ্বসের ঘটনা। এর আগেও অনেক বার অনেক ভবন ধ্বসে পড়েছে কিন্তু এবারের মতো এমন লাশের মিছিল এর আগে দেখতে হয়নি দেশবাসিকে। ধ্বসে পড়া ভবনের ভেতরে যারা আটকে আছেন এবং এখনও জীবিত আছেন তাদের বেঁচে থাকার আকুতি, ওই আটকাবস্থা থেকে উদ্ধার পাবার আকুতি সত্যিই হৃদয়ের গভীরে নাড়া দিয়ে যায়ঃ
১। ভাই, দরকার হলে আমার পা কেটে বের করেন, তবুও আমাকে বাঁচান। আমি আর এই যন্ত্রণা সইতে পারি না।
২। ভাই, আমাকে একটা হাতুড়ি দেন। আমি নিজেকে বের করতে পারবো।
৩। শ্বাস নিতে পারছি না, লাশের গন্ধে মারা যাবো। ভাই, একটু অক্সিজেন আনতে পারবেন?
৪। ভাই, আমাকে এখান থেকে বের করেন। আমার একটা দুই বছরের ছেলে আছে। ওর জন্য আমারে বাঁচান। ওরে দুধ খাওয়াতে হবে।
৫। ভাই, আমার মাকে বইলেন আমাকে মাফ করে দিতে। আমার বাড়ি পিরোজপুর, হুলারহাট। ভাই আমি মারা গেলে লাশটা বাড়িতে পাঠাইয়েন।
এই মানুষগুলি কোটি টাকা, বাড়ি- গাড়ি, বিলাসী জীবন চায় না। ওরা শুধু বেঁচে থাকতে চায়। ওরা কেবল প্রিয় মুখগুলির কাছে ফিরে যেতে চায়।

 উদ্ধার কাজ চালাতে গিয়ে দেখা গেলো এক জায়গায় ধ্বসে পড়া ছাদের নিচে চাপা পড়ে আছেন একজোড়া নারী পুরুষ। পুরুষটি জড়িয়ে ধরে রেখেছেন নারীটিকে। আমার জানা নেই এদের মাঝে সম্পর্ক কি। হতে পারে তারা ভাই- বোন, স্বামী- স্ত্রী, প্রেমিক- প্রেমিকা বা সহকর্মী। ভবন ধ্বসে যাচ্ছে টের পেয়ে হয়তো একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেই অবস্থাতেই মৃত্যু তাদেরকে গ্রাস করেছে। নিজেদের জীবন দিয়েও তারা প্রমান করে গিয়েছেন ভণ্ড, মুনাফাখোর, প্রতারক ব্যবসায়ীদের কারণে মৃত্যুর কঠোরতাও তাদের পরাজিত করতে পারেনি। তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও তারা উঁচু স্তরের মানুষগুলির মতো নিজের গা বাঁচাতে ইয়স্ত না থেকে একে অন্যকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে জানে।

  বি।দ্র। ছবিগুলি গুগল থেকে নেয়া হয়েছে।