বাংলাদেশের প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়। দেশের সব খানে ঠাণ্ডা এক রকম অনুভূত হয় না। সমতল ভুমির চেয়ে পাহাড়ি এবং টিলা এলাকায় ঠাণ্ডা বেশি পড়ে। তবে সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা পড়ে এদেশের উত্তরাঞ্চলে। হিমালয়ের খুব কাছে হবার কারণে ঠাকুর গাঁ এবং পঞ্চগড় এলাকায় ঠাণ্ডার প্রকোপ খুব বেশি।
বাংলাদেশের বিশাল জনসংখ্যার একটি বড়ো অংশ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে যারা দিনে দুইবেলা পেট ভরে খেতেও পায় না। এই শীতের মাঝে তাদের পক্ষে নতুন করে গরম কাপড় কেনা সম্ভব নয়। যার যা কিছু ছেঁড়া – খোঁড়া কাপড় আছে তাই নিয়েই এরা প্রচণ্ড শীতের মাঝে টিকে থাকার লড়াই করে চলে। প্রায়ই চোখে পড়ে যে রাস্তার ধারে এরা পুরনো কাগজ, ঝরা পাতা, গাছের ডালপালা আর ময়লা জড় করে আগুন ধরিয়ে নিজেদের গা গরম রাখার চেষ্টা করে।
মাঝে মাঝে এতো বেশি কুয়াশা পড়ে যে খুব সামান্য দূরত্বের জিনিস ও দেখা যায় না। দিনের বেলাতে ও চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে থাকে। সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না। রাস্তায় দুরপাল্লার গাড়ি গুলি আটকা পড়ে থাকে। মাইলের পর মাইল রাস্তা জুড়ে গাড়ির লাইন লেগে যায়। এই অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে অনেক দুর্ঘটনা ও ঘটে। রানওয়ের লাইট বা লাইন কোনওটাই দেখা যায় না বলে অনেক ফ্লাইট বাতিল করে দেয়া হয়। অনেক সময় রানওয়ের ট্র্যাক দেখা যায় না বলে অনেক প্লেন নামতে না পেরে ফিরেও যায়।
বাংলাদেশে নানা ধর্মও নানা বর্ণের জাতি বাস করে। বিভিন্ন এলাকার লোকজনের তাদের নিজস্ব রীতি রেওয়াজ আছে। বাংলাদেশে শীতকাল মুলত উতসবের মৌসুম। সবাই তাদের নিজেদের রেওয়াজ এবং সাধ্য অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের লোকাচার করে থাকে।
শীতের প্রধান উৎসব হল “নবান্ন”। হেমন্তে কৃষকের ঘরে নতুন ফসল তোলা হয়। সেই ফসল তুলে গোছ গাছ করতে করতেই শীত চলে আসে। গ্রামে বিবাহিত মেয়েদের বাপের বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়। শীতের সকালে বা সন্ধ্যায় পিঠা তৈরি করে সবাই একসাথে বসে ধুমধাম করে পিঠা খাওয়ার উৎসব চলে।
গ্রামাঞ্চলে “গাছি” বলে এক রকমের পেশাজীবী আছে। গাছিদের কাজ হল গাছ কাটা। খেজুর গাছের ছাল তুলে সেখানে বাঁশের নল ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এর পর বিশেষ কায়দায় সেই নলের মাথায় কলসি বাঁধা হয়। সারা রাত নল বেয়ে কলসিতে খেজুর গাছের রস জমে। খুব ভোরে সেই রস নামিয়ে আনা হয়। টাটকা এই খেজুরের রস খেতে খুব সুস্বাদু। এই রস দিয়ে আবার রসের ক্ষীর ও রান্না করা হয়।
শীতকালে গড়পড়তা হারে বিয়ের অনুষ্ঠান অনেক বেশি হয়। অবস্থান গত দিক থেকে বাংলাদেশ গ্রীষ্ম প্রধান দেশ। স্যাঁতস্যাঁতে গরমের দিন অনুষ্ঠানের উপযোগি নয় বলে শীতের মৌসুমকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। আর তা ছাড়া এই সময়ে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে বলে সবাই একটু বেশি ধুমধাম করেই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারে। এছাড়া, এসময়ে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ বা কর্মস্থল থেকে লোকজন দল বেঁধে পিকনিকে যায়।
শহরে শীতের প্রকোপ তুলনা মূলক ভাবে কম থাকে। ঘন বসতি, গায়ে গায়ে ঘেঁষা দালান কোঠা, কলকারখানার ধোঁয়া, গাড়ির ধোঁয়া এই সব মিলিয়ে শহরের আবহাওয়া গরম হয়ে থাকে। কিন্তু খোলামেলা হওয়াতে গ্রামের আবহাওয়া একটু বেশিই ঠাণ্ডা হয়। শীতকালে গ্রামের লোকজনের তেমন কোনও কাজ থাকে না। প্রাকৃতিক জলাধার গুলির পানি শুকিয়ে নিচে নেমে যায়। কিছু লোক সেই সব জলাধারে মাছ ধরে। অনেক এলাকায় যাত্রা পালা বা সার্কাস বা মেলার আয়োজন করা হয়। গ্রামে গ্রামে মসজিদের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় ওয়াজ মাহফিলের। রাতভর এই সব অনুষ্ঠান চলে। ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়ে লোকজন গুটিসুটি মেরে বসে থাকে শেষ রাত পর্যন্ত।
গ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ জুড়ে দেখা যায় হলুদ রঙের সরষে ফুলের সমারোহ। লাউয়ের ডগায় ভোরের শিশির সূর্যের আলো পড়ে ঝিলিক দিয়ে উঠে হীরের মতো। কৃষকের আঙিনা জুড়ে সবজি মাচায় রঙ বেরঙের ফুল ভোরের বাতাসে দোল খায়। ফুলে ফুলে দাপিয়ে বেড়ায় বাহারি প্রজাপতি। দূর দুরান্ত থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে অতিথি পাখি।
যদিও বাংলাদেশে শীতকাল তেমন দীর্ঘায়িত নয় কিন্তু এই স্বল্প পরিসরেই বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে অনেক বর্ণময় বৈচিত্র্য আর কিছু হাসি খুশিতে ভরপুর সুখের মুহূর্ত।
আপনাদের সবার এই শীতকাল আমোদ – আহ্লাদে ভরে থাকুক – এই শুভ কামনা রইলো।
বি।দ্র। ছবিগুলি গুগল থেকে নেয়া হয়েছে।









