রূপময় বাংলাদেশ Headline Animator

28 October, 2013

হেমন্ত এলো ফিরে (late autumn is back)





হেমন্ত এসে গেলো। বেশ ভালো করেই জানান দিচ্ছে নিজের আগমনের। কাশবনের সাদা এখন ফিকে হয়ে এসেছে। শেষ বিকেলে ঝুপ করেই যেন সূর্যটা ডুবে যায়। এই দেখা সোনালি রঙের ঝকঝকে আলো এক ঝলকেই কেমন ম্লান হয়ে যায়। শেষ রাতে কান পাতলেই শোনা যায় শিশিরের টুপটাপ শব্দ। ভোরের শিশির ভেজা ঘাসের উপর বিছিয়ে থাকে ধবধবে শিউলি কিংবা বকুল। আকাশের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ উধাও হয়ে ধীরে ধীরে নীল রঙ ধারন করছে আকাশ। দূর বহুদূর থেকে ডানা ঝাপটে উড়ে আসা শুরু হয়েছে ভিনদেশি পাখিদের। 

আহা! এমন রূপের দেখা কি আর সবখানে মিলে? শুধু এই বাংলাতেই সম্ভব। আমার রূপসী দেশ! আমার মায়াময়ী দেশ! তোমায় ছেড়ে কোথায় যাবো আমি? জননী, জন্মভূমি আমার জীবনের অন্তিম ঠাঁই যেন তোমার কোলেই হয়। 


বি। দ্র। ছবিটি গুগল থেকে নেয়া হয়েছে।

29 April, 2013

দীঘি আর শৈবাল

শৈবাল দীঘিরে বলে উচ্চ করি শির
"লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির"
- ছেলেবেলায় পড়েছিলাম। পড়তাম আর অবাক হতাম। শৈবাল আর দীঘি কি কথা বলতে পারে নাকি! তখন এর যথার্থ মানে বুঝতে পারিনি। এখন সম্ভবত বুঝি। বি জি এম ই এ হল সেই শৈবালের মতো যার অস্তিত্ব শ্রমিকদের দীঘিতে টিকে আছে। বার বার করে এতোগুলো মানুষ মারা যায়, তারা তদন্ত কমিটি করেই খালাস। কোথাও কিছু একটা হল তো সবার আগে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেই তারা খালাস। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আর কোনোদিন আলোর মুখ দেখে না। তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন- এইই তো অনেক বড়ো ব্যাপার। তারা জোর গোলায় দাবি করেন যে বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছেন। ভালো কথা। কিন্তু কি করে এনেছেন? তারা নিজেরা কতোখানি শারীরিক পরিশ্রম করেন বা করেছেন? তাদের কেউ কি কোনোদিন প্রচণ্ড গরমের মাঝে ফ্যান বিহীন ফ্যাক্টরিতে কাজ করেছেন? নাকি তাদের কেউ দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা দাঁড়িয়ে থেকে ডিউটি করেছেন? সপ্তাহের সাত দিনই একটানা কখনো কি খেটে দেখেছেন? তাদের অবহেলায় এতো গুলি মানুষ মারা গেলো। কই, তাদের গণ্য মান্য কেউ তো সাভার গেলেন না কিংবা হাসপাতালে দেখতেও গেলেন না ওই সব হতভাগ্য শ্রমিক গুলি কেমন আছে। 
খালি মুখেই বড়ো বড়ো কথা। এখন আবার নতুন করে ভয় দেখাচ্ছেন যে বাংলাদেশের সব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি তারা বন্ধ করে দেবেন। দিক না বন্ধ করে। আমরাও দেখি গরিবের রক্ত না চুষে ওই সব পাষাণহৃদয় গার্মেন্টস মালিকেরা কি করে অমন বিলাসী জীবনযাপন করেন।

26 April, 2013

উঁচু মহল ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ী বনাম পোশাক শ্রমিক





২৪ শে এপ্রিল বুধবার, ২০১৩, সকাল ৮:৪০ এ বিকট শব্দ তুলে ভেঙে পড়ল সাভারের “রানা প্লাজা”। বাণিজ্যিক এই ভবনটিতে ছিল ব্যাংক- বীমা সহ আরও ৫ টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান। আগের দিন মঙ্গলবার বিকেলেই ভবনটির দেয়ালে বড়ো ধরনের ফাটল দেখা দেয়ায় সব গুলো প্রতিষ্ঠান ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। উপর মহল থেকে আদেশ দেয়া হয় ওই ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত যেন সব কাজ স্থগিত রাখা হয়। এই নিয়ে এক টিভি চ্যানেল প্রতিবেদন তৈরি করতে সাভারে যায়। ভবনের ফাটল নিয়ে প্রশ্ন করলে ওই ভবনের মালিক সোহেল টিভির রিপোর্টারকে বলেন, “ভবনের বড়ো ধরনের কোনও ক্ষতি হয়নি। সামান্য একটু প্লাস্টার খসে পড়েছে। এটা তেমন কিছু না”। এই কথায় গার্মেন্টস মালিকেরাও সুযোগ পেয়ে গেলেন। গার্মেন্টস কর্মীরা একটু শঙ্কা প্রকাশ করছিলেন ভেতরে যাওয়া নিয়ে। কিন্তু তাদেরকে ধমকে ভবনের ভেতরে কাজে নিয়োজিত করা হল। কাজ শুরু করার মাত্র ৪০ মিনিটের মাথায় ওই ভবন ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়লো। ভবন ধ্বসের সময় ভবন মালিক সোহেল রানাও ওই ভবনের নিচের তলায় ছিলেন। জনতার রোষানলে পড়ার ভয়ে তিনি বের হতে না পেরে স্থানীয় সাংসদসহ আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের খবর দেন। পড়ে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সাংসদ তৌহিদ জং মুরাদ ঘটনাস্থলে গিয়ে ভবন মালিক রানাকে বের করে নিয়ে যান। 

ভবন ভেঙে পড়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, “আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ইমারত নির্মাণের নিয়ম কানুন যথাযথ অনুসরণ করা হয়নি বলেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।“ এ ছাড়াও মন্ত্রী বলেন, “কিছু হরতাম সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে। ভবনটি ধ্বসে পড়ার পেছনে সেটিও একটি সম্ভাব্য কারন হতে পারে”। 

ভবন ধ্বসে পড়ার অব্যবহিত পরেই স্থানীয় লোকজন নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার কাজে নেমে পড়েন। তারপর একে একে তাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন ফায়ার ব্রিগেড, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, সেনাবাহিনী এবং প্রচুর সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী। সেই সাথে সবার কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানানো হয়। বাংলাদেশের মানুষ আরও একবার কাজেকর্মে প্রমান করে দেখাল যে তারা আসলেই কতোটা আবেগপ্রবন জাতি। দিন নেই রাত নেই, ধনি গরিবের বিভেদ নেই – সাধারণ মানুষেরা সবাই একজোট হয়ে যে যেভাবে পারে উদ্ধারকাজে সাহায্য করেছে। টাকা দিয়ে, শ্রম দিয়ে, সেবা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সবাই উচুস্তরের স্বার্থান্বেষী মহলকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে তারা করতে চাইলে আসলেই অনেক কিছু করতে পারে। 

বাংলাদেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বিপদ মোকাবিলা করার মতো সরঞ্জাম নেই বললেই চলে। একের পর এক বিপদ ঘটে যাবার পরেও দেশের উপর মহল থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জন্য কোনও পদক্ষেপ গ্রহন করা হয় নি। শুধুমাত্র উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অভাবে উদ্ধার অভিযান বিলম্বিত হচ্ছে। একটু একটু করে দেয়াল ভেঙে বা পিলার কেটে আটকে পড়া লোকজনদের জীবিত বা মৃত বের করে আনা হচ্ছে। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড়ো এবং মর্মান্তিক ভবন ধ্বসের ঘটনা। এর আগেও অনেক বার অনেক ভবন ধ্বসে পড়েছে কিন্তু এবারের মতো এমন লাশের মিছিল এর আগে দেখতে হয়নি দেশবাসিকে। ধ্বসে পড়া ভবনের ভেতরে যারা আটকে আছেন এবং এখনও জীবিত আছেন তাদের বেঁচে থাকার আকুতি, ওই আটকাবস্থা থেকে উদ্ধার পাবার আকুতি সত্যিই হৃদয়ের গভীরে নাড়া দিয়ে যায়ঃ
১। ভাই, দরকার হলে আমার পা কেটে বের করেন, তবুও আমাকে বাঁচান। আমি আর এই যন্ত্রণা সইতে পারি না।
২। ভাই, আমাকে একটা হাতুড়ি দেন। আমি নিজেকে বের করতে পারবো।
৩। শ্বাস নিতে পারছি না, লাশের গন্ধে মারা যাবো। ভাই, একটু অক্সিজেন আনতে পারবেন?
৪। ভাই, আমাকে এখান থেকে বের করেন। আমার একটা দুই বছরের ছেলে আছে। ওর জন্য আমারে বাঁচান। ওরে দুধ খাওয়াতে হবে।
৫। ভাই, আমার মাকে বইলেন আমাকে মাফ করে দিতে। আমার বাড়ি পিরোজপুর, হুলারহাট। ভাই আমি মারা গেলে লাশটা বাড়িতে পাঠাইয়েন।
এই মানুষগুলি কোটি টাকা, বাড়ি- গাড়ি, বিলাসী জীবন চায় না। ওরা শুধু বেঁচে থাকতে চায়। ওরা কেবল প্রিয় মুখগুলির কাছে ফিরে যেতে চায়।

 উদ্ধার কাজ চালাতে গিয়ে দেখা গেলো এক জায়গায় ধ্বসে পড়া ছাদের নিচে চাপা পড়ে আছেন একজোড়া নারী পুরুষ। পুরুষটি জড়িয়ে ধরে রেখেছেন নারীটিকে। আমার জানা নেই এদের মাঝে সম্পর্ক কি। হতে পারে তারা ভাই- বোন, স্বামী- স্ত্রী, প্রেমিক- প্রেমিকা বা সহকর্মী। ভবন ধ্বসে যাচ্ছে টের পেয়ে হয়তো একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেই অবস্থাতেই মৃত্যু তাদেরকে গ্রাস করেছে। নিজেদের জীবন দিয়েও তারা প্রমান করে গিয়েছেন ভণ্ড, মুনাফাখোর, প্রতারক ব্যবসায়ীদের কারণে মৃত্যুর কঠোরতাও তাদের পরাজিত করতে পারেনি। তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও তারা উঁচু স্তরের মানুষগুলির মতো নিজের গা বাঁচাতে ইয়স্ত না থেকে একে অন্যকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে জানে।

  বি।দ্র। ছবিগুলি গুগল থেকে নেয়া হয়েছে।

28 March, 2013

চৈতালি পূর্ণিমা




আজ চৈতালি পূর্ণিমা। বিশেষ কিছু এলাকায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙ্গালি জাতি গোষ্ঠীর কাছে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের দিন। আজ হোলি। হঠাৎ করেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেলো। বাবার চাকরির সুবাদে আমার ছেলেবেলা কেটেছে মানিকগঞ্জে। তখন দেখতাম চৈতালি পূর্ণিমার দিন মানেই ওখানকার গ্রামাঞ্চলে একটি বিশেষ দিন। এই দিনে ঘরে ঘরে মজাদার কিছু খাবার তৈরি করা হতো। 


নিজেরা রঙ মাখামাখি করার পাশাপাশি তাদের পোষা গরুর গায়েও অতি যত্নে রঙ দিয়ে বাহারি নকশা এঁকে সাজিয়ে তোলা হতো। এই দিনে হতো গরু দাবাড়, কুস্তি, ঘুড়ি উৎসব আর নদীর পাড়ে বসতো মেলা। কি থাকতো না সেই মেলায়? বিন্নি খই, ঢ্যাপের খই (শহরের মানুষ হয়তো জানেই না ঢ্যাপ কি জিনিস। শাপলার ফলকে ঢ্যাপ বলে), সাঁজের মিষ্টি, কদমা, তিলের নাড়ু, বাহারি পদের নিমকি কটকটি, জিলিপি, অমৃতি আর টাটকা এলাচের গন্ধ মাখা তুলতুলে রসগোল্লা সহ আরও কতো কি খাবারের দেখা মেলত তার সব নাম মনেও নেই। 


মেলার একধারে বসতো বেদেনির দল। সাপের খেলা আর চোখ জুড়ানো ভেল্কি বাজি দেখিয়ে হাততালির পাশাপাশি খুচরো পয়সাও পেত তারা। কেউ বা কাঁচের বাসনকোসন সাজিয়ে নিয়ে দোকান দিয়ে বসতো। কুমোরের দল আসতো তাদের তৈরি করা মাটির জিনিসপত্র নিয়ে। বাঁশের তৈরি ডালা, কুলো, ঝাড়ু, টুকরি, চাটাই, মাছ ধরার পলো এই সব নিয়ে আসতো কিছু লোক। আরও থাকতো রঙবেরঙের কতো কতো খেলনা। ঘর-গেরস্থালির নিত্য প্রয়োজনীয় দা, বটি, ছুরি, কাস্তে, 

কোদাল, নিড়ানি, খুরপি এইসব নিয়ে আসতো কামারেরা। মেলার একেবারেই এক প্রান্তে বসাত চরকি। আরোহীদের নিয়ে সেই রঙচঙে চরকি ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দ তুলে হেলে দুলে পাক খেত। 

সব কিছু মিলিয়ে কতই না বর্ণিল ছিল সেই সব দিন। এখন কর্মব্যস্ত শহুরে জীবনে সেই রঙ আর রূপ কোনটারই দেখা মেলে না। 

বি।দ্র। ছবিগুলি গুগল থেকে নেয়া হয়েছে। 

28 December, 2012

বাংলাদেশের শীতকাল


হিমেল হাওয়ায় জবুথবু হয়ে একটু উষ্ণতার জন্য সবাই কাতর হয়ে আছে – এমনই দৃশ্য চোখে পড়বে আপনার যদি চোখ মেলে বাইরে তাকান। হ্যাঁ, বাংলাদেশে এখন শীত চলছে। প্রচণ্ড শীত আর কুয়াশায় কাবু হয়ে পড়েছে জন জীবন। প্রাকৃতিক পরিবর্তনের জের হিসেবে এই বাড়তি ঠাণ্ডা হানা দিচ্ছে এই দেশে। গ্রামে গঞ্জে আপামর জন সাধারণের জন্য এই বাড়তি শীত নিঃসন্দেহে বাড়তি কষ্ট নিয়ে এসেছে। তার পরেও আমাদের উৎসবমুখর বাঙালি এরই মাঝে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে জীবন যুদ্ধের পাশাপাশি মেতে থাকে বর্ণীল লোক উৎসবে।

বাংলাদেশের প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়। দেশের সব খানে ঠাণ্ডা এক রকম অনুভূত হয় না। সমতল ভুমির চেয়ে পাহাড়ি এবং টিলা এলাকায় ঠাণ্ডা বেশি পড়ে। তবে সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা পড়ে এদেশের উত্তরাঞ্চলে। হিমালয়ের খুব কাছে হবার কারণে ঠাকুর গাঁ এবং পঞ্চগড় এলাকায় ঠাণ্ডার প্রকোপ খুব বেশি।

বাংলাদেশের বিশাল জনসংখ্যার একটি বড়ো অংশ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে যারা দিনে দুইবেলা পেট ভরে খেতেও পায় না। এই শীতের মাঝে তাদের পক্ষে নতুন করে গরম কাপড় কেনা সম্ভব নয়। যার যা কিছু ছেঁড়া – খোঁড়া কাপড় আছে তাই নিয়েই এরা প্রচণ্ড শীতের মাঝে টিকে থাকার লড়াই করে চলে। প্রায়ই চোখে পড়ে যে রাস্তার ধারে এরা পুরনো কাগজ, ঝরা পাতা, গাছের ডালপালা আর ময়লা জড় করে আগুন ধরিয়ে নিজেদের গা গরম রাখার চেষ্টা করে।

মাঝে মাঝে এতো বেশি কুয়াশা পড়ে যে খুব সামান্য দূরত্বের জিনিস ও দেখা যায় না। দিনের বেলাতে ও চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে থাকে। সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না। রাস্তায় দুরপাল্লার গাড়ি গুলি আটকা পড়ে থাকে। মাইলের পর মাইল রাস্তা জুড়ে গাড়ির লাইন লেগে যায়। এই অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে অনেক দুর্ঘটনা ও ঘটে। রানওয়ের লাইট বা লাইন কোনওটাই দেখা যায় না বলে অনেক ফ্লাইট বাতিল করে দেয়া হয়। অনেক সময় রানওয়ের ট্র্যাক দেখা যায় না বলে অনেক প্লেন নামতে না পেরে ফিরেও যায়।
বাংলাদেশে নানা ধর্মও নানা বর্ণের জাতি বাস করে। বিভিন্ন এলাকার লোকজনের তাদের নিজস্ব রীতি রেওয়াজ আছে। বাংলাদেশে শীতকাল মুলত উতসবের মৌসুম। সবাই তাদের নিজেদের রেওয়াজ এবং সাধ্য অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের লোকাচার করে থাকে।

শীতের প্রধান উৎসব হল “নবান্ন”। হেমন্তে কৃষকের ঘরে নতুন ফসল তোলা হয়। সেই ফসল তুলে গোছ গাছ করতে করতেই শীত চলে আসে। গ্রামে বিবাহিত মেয়েদের বাপের বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়। শীতের সকালে বা সন্ধ্যায় পিঠা তৈরি করে সবাই একসাথে বসে ধুমধাম করে পিঠা খাওয়ার উৎসব চলে।

গ্রামাঞ্চলে “গাছি” বলে এক রকমের পেশাজীবী আছে। গাছিদের কাজ হল গাছ কাটা। খেজুর গাছের ছাল তুলে সেখানে বাঁশের নল ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এর পর বিশেষ কায়দায় সেই নলের মাথায় কলসি বাঁধা হয়। সারা রাত নল বেয়ে কলসিতে খেজুর গাছের রস জমে। খুব ভোরে সেই রস নামিয়ে আনা হয়। টাটকা এই খেজুরের রস খেতে খুব সুস্বাদু। এই রস দিয়ে আবার রসের ক্ষীর ও রান্না করা হয়।
শীতকালে গড়পড়তা হারে বিয়ের অনুষ্ঠান অনেক বেশি হয়। অবস্থান গত দিক থেকে বাংলাদেশ গ্রীষ্ম প্রধান দেশ। স্যাঁতস্যাঁতে গরমের দিন অনুষ্ঠানের উপযোগি নয় বলে শীতের মৌসুমকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। আর তা ছাড়া এই সময়ে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে বলে সবাই একটু বেশি ধুমধাম করেই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারে। এছাড়া, এসময়ে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ বা কর্মস্থল থেকে লোকজন দল বেঁধে পিকনিকে যায়।

শহরে শীতের প্রকোপ তুলনা মূলক ভাবে কম থাকে। ঘন বসতি, গায়ে গায়ে ঘেঁষা দালান কোঠা, কলকারখানার ধোঁয়া, গাড়ির ধোঁয়া এই সব মিলিয়ে শহরের আবহাওয়া গরম হয়ে থাকে। কিন্তু খোলামেলা হওয়াতে গ্রামের আবহাওয়া একটু বেশিই ঠাণ্ডা হয়। শীতকালে গ্রামের লোকজনের তেমন কোনও কাজ থাকে না। প্রাকৃতিক জলাধার গুলির পানি শুকিয়ে নিচে নেমে যায়। কিছু লোক সেই সব জলাধারে মাছ ধরে। অনেক এলাকায় যাত্রা পালা বা সার্কাস বা মেলার আয়োজন করা হয়। গ্রামে গ্রামে মসজিদের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় ওয়াজ মাহফিলের। রাতভর এই সব অনুষ্ঠান চলে। ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়ে লোকজন গুটিসুটি মেরে বসে থাকে শেষ রাত পর্যন্ত।

গ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ জুড়ে দেখা যায় হলুদ রঙের সরষে ফুলের সমারোহ। লাউয়ের ডগায় ভোরের শিশির সূর্যের আলো পড়ে ঝিলিক দিয়ে উঠে হীরের মতো। কৃষকের আঙিনা জুড়ে সবজি মাচায় রঙ বেরঙের ফুল ভোরের বাতাসে দোল খায়। ফুলে ফুলে দাপিয়ে বেড়ায় বাহারি প্রজাপতি। দূর দুরান্ত থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে অতিথি পাখি।

যদিও বাংলাদেশে শীতকাল তেমন দীর্ঘায়িত নয় কিন্তু এই স্বল্প পরিসরেই বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে অনেক বর্ণময় বৈচিত্র্য আর কিছু হাসি খুশিতে ভরপুর সুখের মুহূর্ত।
আপনাদের সবার এই শীতকাল আমোদ – আহ্লাদে ভরে থাকুক – এই শুভ কামনা রইলো।


বি।দ্র। ছবিগুলি গুগল থেকে নেয়া হয়েছে।

07 November, 2012

বাঙালির ঐতিহ্য - গ্রামীণ মেলা



বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন হল গ্রামীণ মেলা। নদীর ধারে, দুই তিন গ্রামের সীমান্তবর্তী কোনও জায়গায়, বড়ো কোনও খোলা মাঠ কিংবা  বিশালাকারের কোনও বট, পাকুড় বা অশ্বত্থ গাছকে কেন্দ্র করে অবস্থিত কোনও খোলা মাঠে  সাধারনত মেলার আয়োজন করা হয়। সেই প্রাচীন কাল থেকে গ্রামীণ জীবনে প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে আসছে এই সব গ্রামীণ মেলা। আগে দূর দুরান্ত থেকে লোক সমাগম হতো এই সব মেলায়। উতসবপ্রিয় বাঙালি নানা রকম ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানের আনুষঙ্গ হিসেবে এই মেলার আয়োজন করে আসছে বরাবরই।


বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস বৈশাখ থেকেই এই উৎসব শুরু হয়ে যায়। শীতের শেষে ফসল কাটার ধুম পড়ে যায়। বৈশাখী ফসল ঘরে তোলার আমেজকে আরেকটু ঝালিয়ে নিতেই এই বৈশাখী মেলার আয়োজন। দূর দুরান্ত থেকে লোকজন আসে এই সব মেলায় তাদের পণ্যের পসরা নিয়ে। কি নেই এখানে? পুঁতির মালা থেকে শুরু করে বাঁশের বাঁশি, কাঠ বা বাঁশ দিয়ে তৈরি নানা রকম খেলনা ও গৃহসামগ্রী, মৃৎ শিল্প ও কারু শিল্প জাত পণ্য সামগ্রী, নানারকম কাঁচের চুড়ি, ছাঁচের তৈরি বাহারি সন্দেশ, নানা রকম খৈ, কদমা, নানা প্রকার মিষ্টি পর্যন্ত সাজান থাকে এই সব মেলায়। কোনও কোনও মেলায় একপাশে থাকে পুতুল নাচ কিংবা পালাগান অথবা বাউল গানের ব্যাবস্থাও। বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদে এই মেলা বসে।


বর্ষাকালে সাধারণত কোনও গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয় না। কিন্তু বর্ষা শেষ হতে না হতেই আবার নতুন উদ্যমে মেলার আয়োজন শুরু হয়ে যায়। গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে বিভিন্ন এলাকায় এই সব মেলা বসে। শরত এলেই পুজার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে যায় হিন্দু জনগোষ্ঠী। আর সেই সাথে তাল মিলিয়ে মেলার ও আয়োজন শুরু হয়। দুর্গা পুজার সময়ে একটু বেশি জাঁকজমকের সাথেই মেলার আয়োজন জমে উঠে।

হেমন্তে নবান্ন উতসবের পাশাপাশি ও মেলা বসে অনেক জায়গায়। শীতের আগে এবং  শীতের সময়ে জাঁকিয়ে বসা এই সব গ্রামীণ মেলায় সাধারনত প্রধান আকর্ষণ থাকে যাত্রাপালা কিংবা সার্কাস। কাঠের তৈরি ছোট ছোট নাগরদোলা ও থাকে অনেক মেলায়।
শীতের শেষে বসন্তে ও মেলা বসে অনেক এলাকায়। এই সব মেলায় প্রধান আকর্ষণ হিসেবে থাকে গরুর দৌড় প্রতিযোগিতা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি খেলা।


আর তা ছাড়া প্রতি বছর শীতের শেষে বগুড়ার পোড়াদহে খুবই আলাদা রকমের মেলার আয়োজন হয়। এই মেলা মাছের মেলা। হ্যাঁ। আপনি ঠিক ই পড়েছেন। মাছের মেলা। দেশের সব এলাকা থেকেই লোক আসে এইখানে। এই মেলার প্রধান আকর্ষণ বিশাল আকারের সব মাছ। তবে এর পাশাপাশি মাঝারি ও ছোট আকারের মাছ ও পাওয়া যায়। আর তার সাথে থাকে গ্রামীণ মেলার সব রকমের আয়োজন। গৃহস্থালি জিনিস থেকে শুরু করে পালাগান, সার্কাস ও নাগরদোলাও।

সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে এখন মানুষের মাঝেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে এখন আর আগের মতো করে সব এলাকায় মেলা জমে উঠে না। কিন্তু আরেকদিকে নতুন নতুন করেও কিছু মেলার আয়োজন ঠিক ই করে নিয়েছে বাঙালির উতসবপ্রিয় সত্ত্বা। কুষ্টিয়ায় বাউল সম্রাট লালনের জন্ম এবং মৃত্যু বার্ষিকীকে উপলক্ষ করে মেলার আয়োজন হয়। নড়াইলে চিত্রশিল্পী সুলতানের বাড়ির পাশেই বসে সুলতান মেলা। যশোরে কবি মধুসুদনের মৃত্যু বার্ষিকীতে আয়োজিত হয় মধু মেলা।


মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। মেলার ধরন ও বদলে যাচ্ছে। এখন মেলা মানেই শুধু নির্দিষ্ট কিছু পণ্য সামগ্রীর বিকিকিনি নয়। এখন মেলা কথাটির পরিসর অনেক বড়ো। বর্ষা কাল বৃক্ষ রোপণের মৌসুম। পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রেহাই পেতে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই বর্ষাকালে এখন পুরো দেশ জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত হয় বৃক্ষ মেলা। নানা রকম ফলদার বৃক্ষ ও কাঠ দানকারী বৃক্ষ ছাড়াও এই মেলায় থাকে দেশি বিদেশি নানা জাতের দৃষ্টি নন্দন গাছের চারা।

বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি আর সংস্কৃতি মানেই গ্রামীণ বাংলার শাশ্বত রূপ আর তার আচার অনুষ্ঠানের সমাহার। যুগ যুগ ধরে এই আচার অনুষ্ঠান চলে আসছে আবহমান বাংলায়। বাঙালির সত্ত্বার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে এই সব লোক অনুষ্ঠান। ধর্ম বর্ণের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিবর্ণ লোক উতসবে পরিণত হয়েছে এই সব গ্রামীণ উৎসব আয়োজন।

বি।দ্র। ছবিগুলি গুগল থেকে নেয়া হয়েছে।

03 November, 2012

বাংলাদেশের হস্তশিল্প : বাঁশ ও বেতের শিল্প ২


বেতের শিল্প বাঁশের শিল্পের মতো যদিও পুরো দেশ জুড়ে ছড়ানো নয় – তার পরেও এই শিল্প দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও তার নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভাবে মূলত সিলেটেই বেতের সামগ্রী তৈরি করা শুরু হয়। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে সিলেটের বেত শিল্প অনেক দূর এগিয়েছে। কয়েক বছর আগে সিলেটে মাত্র হাতে গোণা কিছু সংখ্যক বেতের আসবাবের দোকান ছিল।

১৮৮৫ সালে সিলেটে প্রথম বেতের আসবাব ম্যানুফেকচার করা হয়। তখন সিলেটে যে পরিমান বেত তৈরি হতো তা দিয়েই প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো যেতো। কিন্তু ১৯২৬ সালের পর থেকে ওখানে বেতের উৎপাদন কমে আসতে থাকে। এখন চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় বেতের বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়।

সিলেটে এখন প্রায় ৫০ রকমের বেতের সামগ্রী তৈরি করা হয়। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হল – ম্যাগাজিন র‍্যাক, সোফা সেট, খাট, জুতার র‍্যাক, চায়ের ট্রলি, পড়ার টেবিল - চেয়ার, ড্রেসিং টেবিল, খাবার টেবিল – চেয়ার সেট, কফি টেবিল, বইয়ের শেলফ, ইজি চেয়ার, বাগানের চেয়ার সেট, খবরের কাগজের ঝুড়ি, কাপড় রাখার স্ট্যান্ড, বাচ্চাদের খাট, মোড়া, দোলনা, বোতল রাখার র‍্যাক, প্ল্যানটার, ওয়ারড্রব, আয়নার ফ্রেম, কর্নার স্ট্যান্ড, পার্টিশন ইত্যাদি। এই সব পণ্যের বেশির ভাগই ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হয়। তা ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানেও বেতের তৈরি এই সব পণ্য সামগ্রী বিক্রি করা হয়। 

কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও যশোর এলাকায় বেতের সামগ্রী তৈরি করা হয়। তবে এই সব এলাকায় প্রধানত দেশি ও বার্মা থেকে আনা বেত দিয়ে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে বেতের পন্য সামগ্রী তৈরি করা হয়। এই সব পণ্যের রয়েছে – সোফা সেট, খাট, মোড়া, দোলনা, ড্রেসিং টেবিল, ইজি চেয়ার, রকিং চেয়ার ইত্যাদি। স্থানীয় কারিগরেরা বলেছেন যে উপযুক্ত পৃষ্ঠ পোষকতা পেলে তাদের তৈরি বেতের পন্য সামগ্রী দেশের বাইরেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষিপুর এলাকায় ও বেতের সামগ্রী তৈরি করা হয়। সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় পরিবহণ সুবিধা পাওয়ায় এই বিস্তৃত এলাকা জুড়ে বেতের শিল্প গড়ে উথেছিল এক সময়। কিন্তু এখন প্রয়োজনীয় পুঁজি, উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা, বাজারজাতকরণের জটিলতা  এবং কাঁচামালের সংকটের কারনে অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিয়ে জীবন ধারনের জন্য অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। সোনা গাজীতে এখনও বেতের শিল্প টিকে আছে এবং স্থানিয় পেশাজীবীরা তাদের পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। এই এলাকায় তৈরি করা হয় ডুলা, মোড়া, জুংগর, হাত পাখা, হাঁফটা, মই দোড়া, আন্তা ইত্যাদি। সোনাগাজীর তৈরি শীতল পাটির চাহিদা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের বাইরে ও রয়েছে।